স্বদেশ ডেস্ক:
ফ্রান্স থেকে ১৭৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি রাডার ক্রয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিতে সরকারি অর্থায়নে রাডার ক্রয় অনুমোদনের ফাইল সম্প্রতি পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি জানতে পারেন ১৭৫৫ কোটি টাকায় যে রাডার কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে; সেটি ৬৩০ কোটি টাকাতেই কেনা সম্ভব। অতিরিক্ত ১১২৫ কোটি টাকা যাবে নেপথ্যের সিন্ডিকেটের পকেটে।
এ তথ্য জানার পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে নিবিড় খোঁজখবর নেন এবং মধ্যস্বত্বভোগী সেই সিন্ডিকেটের ফাঁদ এড়িয়ে জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে ফ্রান্স থেকে রাডার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সেই সঙ্গে ১৭৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাডার ক্রয়ের প্রস্তাবে মন্ত্রিসভা কমিটির দেওয়া অনুমোদনও বাতিল করে দেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে ১১২৫ কোটি টাকা লুটপাটে সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র। একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থাপিত চল্লিশ বছরের পুরনো রাডারে নিরাপদ বিমান চলাচল ও দেশের আকাশসীমা নজরদারি প্রায় কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিতে আয়কর ও ভ্যাট ব্যতীত ১৭৫৫ কোটি টাকার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে প্রকল্পটি পিপিপির পরিবর্তে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়নের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এরপর একাধিক বৈঠকে একই প্রস্তাব অব্যাহত ছিল। সব জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রকল্পটি সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সেখানেই ভেস্তে যায় পুকুরচুরির পরিকল্পনা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ফ্রান্সের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে এখন রাডার বসানোর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। মূলত তাঁর দূরদর্শিতায় ১১২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। কেননা এ রাডার প্রকল্পটি এর আগে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি দিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়ে এ পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটি রাডার প্রকল্পে এত টাকা ব্যয়ের বিষয়টি সবার মনে সন্দেহ ও বির্তকের উদ্রেক করায় তা আর চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের কাছ থেকে সরাসরি জিটুজি পদ্ধতিতে রাডার কেনার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রকল্পটিতে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু দেশের স্বার্থে সিভিল এভিয়েশন, মন্ত্রণালয় ও সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহলের সজাগ দৃষ্টি ও আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে রাডার প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পেয়েছে।
প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে দেশের এভিয়েশন খাতে যোগ হবে নতুন মাইলফলক। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে নিরাপদ বিমান চলাচল আরও নির্বিঘ্নে নিশ্চিত ও বিশ্বমানে উন্নীত হবে। মূলত নেভিগেশন সিস্টেমকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ আকাশ চলাচলের জন্যই সিএনএস-এটিএম নামে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বা বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় ১১২৫ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের হাত থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে জানিয়ে বলেন, এখন তিন বছরের মধ্যে এটি স্থাপন করা হবে। এ রাডারের মাধ্যমে দেশের আকাশপথের নিরাপত্তা আরও মসৃণ হবে।
রাডারটি কোথায় স্থাপন করা হবে জানতে চাইলে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে বর্তমান ভিআইপি গেটের পাশে বসানোর কথা ছিল। কিন্তু বলাকা ভবনের সামনে যাতে এমন একটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার সবার নজর কাড়ে। বর্তমানে এখানে সয়েল টেস্ট চলছে। বলাকার পাশে হলে টাওয়ারের উচ্চতা করা যাবে ৫৫ মিটার। সবদিক থেকেই এটা ভালো হবে।
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, এই রাডারের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক আগেই। দীর্ঘদিনের পুরাতন রাডার দিয়ে দেশের পূর্ণ সীমানা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে অন্য দেশের বিমান বাংলাদেশের আকাশপথ ব্যবহার করলেও রাজস্ব বা জরিমানা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে সমুদ্রে বাংলাদেশ প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা অধিকার পায়। বিশাল এই সমুেদ্রর আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়া নতুন অধিকার পাওয়া সমুদ্রে চলাচলকারী অন্য দেশের উড়োজাহাজ থেকে রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে নতুন রাডার স্থাপন অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বে অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোয় ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানির রাডার ব্যবহার করছে। থ্যালাস বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ সফল উৎক্ষেপণ করে। এর আগে ১৯৮০ সালেও জিটুজি’র ভিত্তিতে থ্যালাস বাংলাদেশে রাডার ও নেভিগেশন সিস্টেম চালু করে, যা এখন পর্যন্ত চালু রয়েছে এবং উড়োজাহাজের নিরাপদ উড্ডয়ন-অবতরণ নিশ্চিত করছে।
নতুন রাডার বসাতে ২০০৫ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পুরনো রাডার প্রতিস্থাপনে উদ্যোগ নেয় বেবিচক। ২০১২ সালে পিপিপির আওতায় রাডার স্থাপন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিলে ২০১৫ সালে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানোয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে দেয়।
সূত্র জানিয়েছে, রাডার ক্রয়ের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকারও বেশি লুটপাট করতে প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। তারা ১৭৫৫ কোটি টাকা দিয়ে রাডার কিনতে ঘাটে ঘাটে বাধার সৃষ্টি করে। এছাড়া ভুল তথ্যও পরিবেশন করে। এই সিন্ডিকেটে সাবেক মন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতার ভাগ্নে।